ঢাকা, ২০২৪-০৫-১৯ | ৪ জ্যৈষ্ঠ,  ১৪৩১

বাণিজ্য ঘাটতি কাটিয়ে খুলছে অর্থনীতির নতুন দ্বার

প্রবাস নিউজ ডেস্কঃ

প্রকাশিত: ০১:২৮, ৭ মে ২০২৪  

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর প্রথম দিকে স্বীকৃতিদানকারী দেশগুলোর মধ্যে একটি থাইল্যান্ড। স্বাধীনতার এত বছরেও দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য সম্ভাবনার দ্বার খুব একটা উন্মোচিত হয়নি। ১৯৭২ সালের পর এই প্রথম দেশটিতে ছয়দিনের রাষ্ট্রীয় সফর করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে নতুন করে অর্থনীতির একটি দুয়ার খুলেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

ব্যবসায়ীরাও বলছেন, দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত সফরে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতাও হয়েছে। ধীরে ধীরে বাকি সব প্রত্যাশাও পূরণ হবে। দু’দেশের বাণিজ্য ঘাটতি কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি ব্যবসার নতুন নতুন ক্ষেত্র প্রসারিত হবে বলে মনে করেন তারা।

ব্যাংক অব থাইল্যান্ডের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের বাণিজ্যের মধ্যে থাইল্যান্ড থেকে আমদানির পরিমাণ ছিল মাত্র ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৯০ মিলিয়ন ডলার।

‘থাইল্যান্ডের রেনং বন্দর থেকে সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে কোস্টাল শিপিং চালু হলে চার-পাঁচদিনে ৫/৭/১০ হাজার টনের পণ্যবাহী ভেসেল চলে আসতে পারবে। এটা নিয়ে কাজ করা গেলে ভালো হয়। এছাড়া থাইল্যান্ডের স্বাস্থ্য ও কৃষিখাতের প্রযুক্তি এবং অভিজ্ঞতা বিনিময় করা গেলে ভালো হয়। সবমিলিয়ে আমাদের কাছে মনে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সফর অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে।’— এফবিসিসিআই সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম

ব্যাংককে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের তথ্য বলছে, থাইল্যান্ডে বিভিন্ন ধরনের বস্ত্র, তৈরি পোশাক, প্রাণিজপণ্য, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক উপকরণ এবং মাছ রফতানি করে বাংলাদেশ। আমদানি করে কটন ও কটন ফেব্রিকস, শিল্প যন্ত্রপাতি, চিনি ও চিনি-জাতদ্রব্য, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীসহ আরও কিছু পণ্য। এর বাইরে থাই বাজারে ওষুধ ও রাসায়নিক, রাসায়নিকপণ্য, চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য, ফ্রোজেন ফিশ, কাঁচাপাট ও পাটজাতদ্রব্য, নিটওয়্যার ও ওভেন গার্মেন্ট এবং চায়ের মতো কিছু পণ্য রপ্তানির সম্ভাবনা রয়েছে।

এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘থাইল্যান্ড আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ। থাইল্যান্ডের সঙ্গে আমাদের অনেক বাণিজ্য সুবিধা আছে। থাইল্যান্ডের রেনং বন্দর থেকে সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে কোস্টাল শিপিং চালু হলে চার-পাঁচদিনে ৫/৭/১০ হাজার টনের পণ্যবাহী ভেসেল চলে আসতে পারবে। এটা নিয়ে কাজ করা গেলে ভালো হয়। এছাড়া স্বাস্থ্যখাতসহ নানা বিষয়ে আমাদের আগ্রহ আছে। এছাড়া থাইল্যান্ডের স্বাস্থ্য ও কৃষিখাতের প্রযুক্তি এবং অভিজ্ঞতা বিনিময় করা গেলে ভালো হয়। সবমিলিয়ে আমাদের কাছে মনে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সফর অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে। থাইল্যান্ডের সঙ্গে যদি ব্যবসা বাড়াতে পারি, তাহলে আরও ভালো হবে।’

‘আমাদের প্রত্যাশা থাইল্যান্ডের শ্রমবাজার যেন ধরতে পারি। এখন কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, লাওস- এ তিন দেশের দখলে থাই শ্রমবাজার। এখানে বাংলাদেশি শ্রমিকদের আনতে পারলে রেমিট্যান্স বাড়বে ও কর্মসংস্থান তৈরি হবে। তবে, এটা সহজ নয়, নেত্রী আসায় আশার আলো দেখছি। আশাকরি অদূর ভবিষ্যতে এটাও (শ্রমবাজার) হবে।’— থাইল্যান্ড প্রবাসী ব্যবসায়ী সোহাগ হাওলাদার

থাইল্যান্ড প্রবাসী ব্যবসায়ী মো. সোহাগ হাওলাদার বলেন, ‘৭২ সালের পরে এই প্রথম বাংলাদেশের কোনো সরকারপ্রধান থাইল্যান্ডে রাষ্ট্রীয় সফর করেছেন। এ সফরের প্রত্যাশার তো শেষ নেই। যেসব চুক্তি বা সমঝোতা হয়েছে, সেগুলো তো হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো- দীর্ঘসময় পরে হলেও সফরের মধ্যদিয়ে দু’দেশের মধ্যে একটা সম্পর্ক জোরদার হলো। এর মধ্যদিয়ে সামনে আরও অনেক কিছু হওয়ার দ্বার উন্মোচিত হলো।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা থাইল্যান্ডের শ্রমবাজার যেন ধরতে পারি। এখন কম্বোডিয়া, মিয়ানমার, লাওস- এ তিন দেশের দখলে থাই শ্রমবাজার। এখানে বাংলাদেশি শ্রমিকদের আনতে পারলে রেমিট্যান্স বাড়বে ও কর্মসংস্থান তৈরি হবে। তবে, এটা সহজ নয়, নেত্রী আসায় আশার আলো দেখছি। একটা সফর তো হলো। সামনে আরও হবে। আশাকরি, অদূর ভবিষ্যতে এটাও (শ্রমবাজার) হবে।’

থাইল্যান্ড সফরের প্রাপ্তি নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘থাইল্যান্ড সফরে কী পেলাম আর কী পেলাম না- সেটা বড় বিষয় নয়। নতুন করে কিন্তু অর্থনীতির একটি দুয়ার খুলেছে। থাইল্যান্ডের সঙ্গে খাদ্য ও ফল উৎপাদনের বিষয়ে মতবিনিময় করা হয়েছে। থাইল্যান্ডকে বিনিয়োগ করার আহ্বান করা হয়েছে। পাসপোর্ট ছাড়া যেন বাংলাদেশ থেকে থাইল্যান্ডে যাওয়া যায়, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।’

বাণিজ্য ঘাটতি কাটিয়ে খুলছে অর্থনীতির নতুন দ্বার

তিনি বলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোটের (আসিয়ান) গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রাষ্ট্র থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের সরকারি সফর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সফরে দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধিসহ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা শুরুর বিষয়ে অগ্রগতি, আন্তঃযোগাযোগ বৃদ্ধি প্রভৃতি দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ়করণে বিশেষ গুরুত্ব পালন করবে।

২০২৪ সালের মধ্যে বাংলাদেশ আসিয়ানের ‘সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার’র প্রার্থিতা লাভের জন্য এ সফর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত আলোচনা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহায়তা করবে মর্মে আমি আশাবাদী। আমি মনে করি, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ-সুরক্ষা এবং আঞ্চলিক সম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য সফরটি সফল ও ফলপ্রসূ হয়েছে।

গত ২৪ থেকে ২৯ এপ্রিল থাইল্যান্ড সফর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সফরে দেশটির সঙ্গে সহযোগিতা প্রসারে একটি চুক্তি, তিনটি সমঝোতা স্মারক ও একটি লেটার অব ইন্টেন্ট সই হয়েছে। এগুলো হলো- অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা অব্যাহতি সংক্রান্ত চুক্তি। জ্বালানি, পর্যটন ও শুল্ক সংক্রান্ত পারস্পরিক সহযোগিতা বিষয়ক তিনটি সমঝোতা স্মারক এবং মুক্তবাণিজ্য চুক্তির আলোচনা শুরুর জন্য একটি লেটার অব ইন্টেন্ট সই হয়। এর বাইরে বিনিয়োগ, জনগণের মধ্যে যোগাযোগ, সাংস্কৃতিক বিনিময়, পর্যটন সহযোগিতা, জ্বালানি নিরাপত্তা, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, স্থল এবং সমুদ্র সংযোগ, উন্নয়ন সহযোগিতা এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিষয়ে আলোচনা হয়।

দু’দেশের বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষার জন্য বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং হাইটেক পার্কে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার জন্য থাই প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন শেখ হাসিনা। পাশাপাশি তৈরি পোশাকসহ কিছু বাংলাদেশি পণ্যের একটি যুক্তিসংগত সময়ের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধার বিষয়টি বিবেচনা করার অনুরোধ করেন।

বাণিজ্য ঘাটতি কাটিয়ে খুলছে অর্থনীতির নতুন দ্বার

কৃষি উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে কৃষিখাতে পারস্পরিক সহযোগতিা বৃদ্ধির মাধ্যমে থাইল্যান্ডের অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা কাজে লাগিয়ে খাদ্যনিরাপত্তা সুদৃঢ় করতে থাইল্যান্ডের সঙ্গে সহযোগতিা বৃদ্ধির বিষয়ে আলোচনা হয়। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধির ব্যাপারেও আলোচনা হয়। থাইল্যান্ডকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগেরও আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

নিরবচ্ছিন্ন আঞ্চলিক যোগাযোগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে থাইল্যান্ডের রেনং বন্দর এবং চট্টগ্রাম বন্দরের মধ্যে সরাসরি কোস্টাল শিপিং দ্রুত চালুর মাধ্যমে দু’দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে একমত পোষণ করে উভয় দেশ।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়