ঢাকা, ২০২৪-০৫-০৯ | ২৫ বৈশাখ,  ১৪৩১

আইএমএফের নতুন নীতির কী প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে?

প্রবাস নিউজ ডেস্কঃ

প্রকাশিত: ২৩:৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪  

ঋণ দুর্দশাগ্রস্ত দেশগুলোকে আর্থিক স্বস্তি দিতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ঋণ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে নতুন নীতিমালা ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ)। এখন থেকে চূড়ান্ত আর্থিক নিশ্চয়তাপত্র না থাকলেও, শুধুমাত্র নির্ভরযোগ্য আশ্বাসেই মিলবে ঋণ। ফলে ঋণ প্রক্রিয়া অনুমোদনের মধ্যবর্তী মূল্যবান সময় ও ঝামেলা কমতে যাচ্ছে আবেদনকারী দেশগুলোর।

 

 

গত মঙ্গলবার (১৬ এপ্রিল) এক বিবৃতিতে আইএমএফের নির্বাহী পরিষদের এক সভায় ৯ এপ্রিল বিষয়টি অনুমোদন হয় বলে জানায় সংস্থাটির কর্তৃপক্ষ।

নতুন নীতিমালা অনুযায়ী ঋণ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশকে আর আইএমএফের চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হবে না। বরং ঋণ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে সংস্থাটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে চুক্তি থেকে শুরু করে, চূড়ান্ত পর্যায়ে আইএমএফ বোর্ডের অনুমোদন পাওয়ার মধ্যবর্তী সময়ের পুরো ঋণ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হবে মাত্র ২ মাসের মধ্যে।

 

অথচ এই ঋণ পুনর্গঠনের অনুমোদন পেতে আফ্রিকার দেশ জাম্বিয়ার ৯ মাস, শ্রীলঙ্কার ৬ মাস ও ঘানার ক্ষেত্রে ৫ মাস সময় লাগে।

 

মূলত আইএমএফের সঙ্গে ঋণ কর্মসূচিতে যেতে হলে, যে কোন দেশকে তার অন্যান্য সব আন্তর্জাতিক ঋণদাতার কাছ থেকে আর্থিক নিশ্চয়তার ছাড়পত্র পেতে হয়। আন্তর্জাতিক নীতি অনুযায়ী যা অত্যাবশ্যক। তবে অন্য আন্তর্জাতিক ঋণদাতারা এই ছাড়পত্র দেয়ার ব্যাপারে বিলম্ব না করলেও, আন্তর্জাতিক ঋণদাতা হিসেবে চীনের ছাড়পত্র পাওয়ার বিষয়টি বেইজিংয়ের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তুলনামূলক দীর্ঘ হয়। এর অন্যতম কারণ হলো গুরুত্বপূর্ণ ও বড় ঋণ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে আর্থিক নিশ্চয়তার ছাড়পত্রের বিষয়টি অনুমোদন দেয় চীনের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী পরিষদ ‘স্টেট কাউন্সিল’।

 

তবে নতুন নিয়ম অনুযায়ী এখন থেকে ঋণদাতাদের থেকে আর্থিক নিশ্চয়তার বদলে তাদের থেকে নির্ভরযোগ্য আশ্বাস পেলেই ঋণ পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া সামনে এগিয়ে নেবে আইএমএফ। এর ফলে চীনের থেকে আর্থিক নিশ্চয়তার চূড়ান্ত ছাড়পত্র পেতে দেরি হলেও, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে আটকে থাকবে না কোন দেশের ঋণ পুনর্গঠনের আবেদন।

 

উল্লেখ্য, বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অন্যতম প্রধান ঋণদাতায় পরিণত হয়েছে চীন। তবে ঋণ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আর্থিক নিশ্চয়তার চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে এই দেশগুলোকে মুখোমুখি হতে হয় চীনের অভ্যন্তরীণ আমলাতান্ত্রিক জটিলতার। এর ফলে জাম্বিয়া কিংবা শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোকে ঋণ পুনর্গঠনে অপেক্ষা করতে হয় মাসের পর মাস।

 

আইএমএফের এই নতুন নীতিমালার বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন সময় সংবাদকে বলেন, কোন দেশের ঋণ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে আইএমএফ বোর্ডের তরফ থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে হলে, সংশ্লিষ্ট দেশকে আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের থেকে ফিন্যান্সিয়াল অ্যাসুরেন্স বা আর্থিক নিশ্চয়তার ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে যত দ্রুত আন্তর্জাতিক ঋণদাতাদের থেকে এই ছাড়পত্র পাওয়া যায়, তত দ্রুত সংশ্লিষ্ট দেশের ঋণ পুনর্গঠনের বিষয়টি আইএমএফ বোর্ডে অনুমোদিত হয়। তবে এই ছাড়পত্র পেতে যত দেরি হবে, ঋণ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে আইএমএফের স্টাফ লেভেলের চুক্তি থেকে শুরু করে বোর্ডের সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তির মধ্যবর্তী সময় তত বেশি দীর্ঘ হবে।

 

আইএমএফের এই নতুন নির্দেশনার ব্যাপারে তিনি বলেন, মূলত শ্রীলঙ্কা ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে আইএমএফের ঋণ পুনর্গঠনের সময় ঐ দেশগুলোর চীনের আর্থিক নিশ্চয়তার ছাড়পত্র পেতে বিলম্ব হয়। এ কারণে ঐ দেশগুলোতে আইএমএফের ঋণ পুনর্গঠনের কার্যক্রম দীর্ঘসূত্রিতায় আক্রান্ত হয়েছিলো। এই পরিস্থিতি যেন ভবিষ্যতে এড়ানো যায়, সেজন্যই হয়তো আইএমএফ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

 

শ্রীলঙ্কা, ঘানা ও জাম্বিয়ায় আইএমএফের ঋণ পুনর্গঠনে তুলনামূলক বেশি সময় লাগে এই জন্য। এর কারণ হলো এই দেশগুলোর চীনা ঋণের জন্য বাধাপ্রাপ্ত হওয়া। চীনা ঋণগ্রস্ত এই দেশগুলোতে আইএমএফের কর্মসূচি চালুর জন্য প্রয়োজন ছিল ঋণদাতা চীনের আর্থিক নিশ্চয়তার ছাড়পত্র। কিন্তু চীনের ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো যেহেতু প্রায় পুরোপুরি সরকার নিয়ন্ত্রিত, এবং এসব ব্যাপারে অনুমোদন আসে চীন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতি নির্ধারণী পরিষদ থেকে। তাই চীনের অভ্যন্তরীণ আমলাতান্ত্রিক জটিলতার জন্য ঐ দেশগুলোর এই আর্থিক নিশ্চয়তার ছাড়পত্র পেতে অনেক দেরি হয়।

 

ভবিষ্যতে যেন আর কোন দেশকে চীনের অভ্যন্তরীণ আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে ঋণ পেতে এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়, সে জন্যই আইএমএফ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করছেন জাহিদ হোসেন।

 

তিনি বলেন, আগের নিয়ম অনুযায়ী ঋণ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে একটি দেশকে ঋণ দেয়া প্রত্যেক ঋণদাতারই আর্থিক নিশ্চয়তার প্রয়োজন হয়। প্রত্যেক ঋণদাতার সম্মতি না পাওয়া পর্যন্ত ঋণ পুনর্গঠনের চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় না আইএমএফ।

 

তবে মঙ্গলবার প্রকাশিত নতুন নিয়ম অনুযায়ী, এ ধরনের আর্থিক নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত অনুমোদনের বদলে ঋণদাতার পক্ষে ‘নির্ভরযোগ্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া’কেই গ্রহণ করবে আইএমএফ। এর ফলে চীনের চূড়ান্ত ছাড়পত্র ছাড়াই সংশ্লিষ্ট ঋণগ্রহীতা দেশের সঙ্গে আইএমএফের স্টাফ লেভেল থেকে শুরু করে বোর্ড লেভেল পর্যন্ত চুক্তির কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। সেক্ষেত্রে শুধু চীনের সংশ্লিষ্ট ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের তরফে আশ্বাস পেলেই চলবে।

 

জাহিদ হোসেন বলেন, কোন দেশ বিভিন্ন তরফে ঋণ নিয়ে থাকে। এর মধ্যে কোন কোন ঋণ থাকে আইএমএফের মতো আন্তর্জাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের থেকে নেয়া। আবার কখনও দ্বিপক্ষীয়ভাবে কোন নির্দিষ্ট দেশ থেকেও ঋণ নেয়া হয়ে থাকে। আর দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী ঋণ দান করার ক্ষেত্রে চীন এখন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ঋণদাতা।

 

আফ্রিকা বা এশিয়ার ঋণ দুর্দশাগ্রস্ত দেশগুলোকে ঋণ পুনর্গঠন করতে হলে, প্রত্যেক ঋণদাতার অনুমতির প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে আইএমএফের ঋণ পেতে হলেও সংশ্লিষ্ট দেশকে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা হিসেবে চীনের অনুমোদনও অত্যাবশ্যক।

 

তবে বাংলাদেশের জন্য আপাতত আইএমএফের সিদ্ধান্তের তেমন কোন তাৎপর্য নেই উল্লেখ করে জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশ আর্থিকভাবে এমন কোন দুর্দশায় নেই যে আইএমএফ কিংবা অন্যান্য আন্তর্জাতিক ঋণদাতার কাছে ঋণ পুনর্গঠনের জন্য আবেদন করতে হবে। কখনও বাংলাদেশ এই ঋণ পুনর্গঠনের মতো পরিস্থিতিতে পড়লে, তখন নতুন নীতির আওতায় বাংলাদেশও সুবিধা পাবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

 

তবে আইএমএফের সিদ্ধান্ত কেবলমাত্র ঘোষণা আকারে এসেছে। এই সিদ্ধান্তকে কাগজে-কলমে বাস্তবায়ন কীভাবে করা হবে, তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে বলে উল্লেখ করেন জাহিদ হোসেন।

 

তিনি বলেন, এক্ষেত্রে একটা আশঙ্কা আছে যে আর্থিক নিশ্চয়তার ছাড়পত্রের ব্যাপারে আশ্বাস পাওয়ার পর যখন ঋণ পুনর্গঠনের বিষয়টি আইএমএফের চূড়ান্ত অনুমোদনের পর্যায়ে উপনীত হবে, তখন এমনও হতে পারে, শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসতে পারে ঋণদাতা দেশ। সেক্ষেত্রে তো পুরো প্রক্রিয়াটি ফের স্থবির হয়ে যাবে।

 

এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ভূ-রাজনীতি এবং ঋণপুনর্গঠন প্রত্যাশী দেশের সঙ্গে ঋণদাতা দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের গভীরতা কতটুকু ইত্যাদিও প্রভাব ফেলতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

 

 

সর্বশেষ
জনপ্রিয়